আমাদের ঘুড়ির কথা

রং এর মোহময় মন ভোলানো রংধনু তোরণ পেরিয়ে মন হারানোর প্রান্তর আকাশ সকল বয়সের মানুষের কাছেই রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। আকাশে পাখী ওড়ে দূর আকাশে মেঘ ওড়ে, মানুষের মনও ওড়ে। শুধু রূপ কথার ইকারাস দেদেলাস কেন আমরা মানব কুল সকল যুগেই আকাশ জয়ে ব্যক্তিগত ও জাতীয় যোগ্যতা সামর্থ অনুযায় ব্রতি হয়ে আছি এবং সে তাগিদে মহাকাশ, চন্দ্র, মঙ্গল, শনি জয় করেই চলেছি । হট এয়ার বেলুন, জ্যাপলিন, গ্যাস বেলুন, উড়োজাহাজ, গাইরো প্লেন, গ্লাইন্ডার, হেলিকপ্টার, রকেট সবই মানব জাতি উদ্ভাবন আবিস্কার করেছে আকাশ জয়ের নেশায়। সেই নেশার, অন্যতম রূপ ঘুড়ি
আমাদের দেশেও শত শত বৎসর থেকে ঘুড়িমোদি ঘুড়ি প্রেমিকরা ঘুড়ি তৈরী করে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। আমাদের দেশে পতেঙ্গা ঘুড়িই বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয়। সংস্কৃত শব্দ পতাঙ্গ এর অর্থ ঘুড়ি। সম্ভবত পতাঙ্গ শব্দ থেকে পতেঙ্গা নামের আগমন। পতেঙ্গা ঘুড়ি তৈরী ও ওড়ানো সহজ। সাধারনত পতেঙ্গা ঘুড়িই দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে পতেঙ্গা ঘুড়ি ছাড়াও ঘুড়ি কুশলীগণ আরো তৈরী করেন ঢোপ ডাউস, চিলা, উড়োজাহাজ কোয়ারে, মাছ ও চিলি ইত্যাদি ঘুড়ি। সৌখিন মেধাবী রোমান্টিক কারিগড়রা যার যার মত তিলে তিলে শ্রম ও মেধা দিয়ে তৈরী করেন এ সকল বড় আকারের ও ভিন্ন আকৃতির ঘুড়ি । এ সকল ঘুড়ি অবশ্য দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। অনেক পরিশ্রমের ফল বিশিষ্ট ডিজাইনের ঘুড়ি কখনো কখনো ওড়েও না। এতদিন আমাদের দেশে মূলত ঘুড়ির ডিজাইন করা হতো শুধু অনুমান ও ধারনার উপর ভিত্তি করে। উন্নত সব দেশে বায়ু গতি-সূত্র নির্ভর ডিজাইন তৈরী করা হয়। এই পদ্ধতি আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে।
ঘুড়ি তৈরীতে কতগুলি অপরিহার্য্য হিসাব আছে। সুক্ষভাবে হিসাব মেনে নকসা করতে হয। শুদ্ধ নকসা অনুসরন করে নিখুঁত ভাবে ঘুড়ি তৈরী করতে হয়। তা না হলে ঘুড়ি ওড়বে না।
আমাদের দেশে ঘুড়ি তৈরীতে মূূলত বাঁশের শলা, বিভিন্ন জাতের কাগজ আঠা সূতা ইত্যাদি ব্যবহার হয়, সাধারনত ঘুড়ির কাঠামোটি স্থায়ীভাবে তৈরী করা হয়।
চীন সহ উন্নত দেশে ঘুড়ির আকার আকৃতির যেমনি বৈচিত্র থাকে উপকরণ ও তেমনি থাকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর। আধুনিক ঘুড়ির কাঠামো তৈরীতে কার্বন রড(শলাকা),পলিভিনাইল রড, গ্লাস ফাইবার রড এবং ছাউনী হিসাবে অতি সূক্ষ সিল্ক থেকে শুরু করে বহুবিধ কাপড় ব্যবহার করা হয়। কাঠামো তৈরীতে খোলা ও জোড়ার সুবিধার জন্য আরো ব্যবহার করা হয় বহু রকমের জয়েন্ট ও বহু রকম সূবিধা জনক কাঠামো ও ছাউনী তৈরীর উপকরন । এ সকল ঘুড়ির বড় বৈশিষ্ট হল পরিবহনের সুবিধার জন্য প্রায় সকল ঘুড়িই খুলে ভাজ করে ছোট আকৃতির করে একটি সরু ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুড়ি তৈরী করে আবার ওড়ানো ও যায়।
ঘুড়ি প্রেমিকরা নিত্য নুতন ঘুড়ি তৈরী করছেন। ড্রাগন থেকে শুরু করে পাখী,কিট, পতঙ্গ,মাছ,ঘর বাড়ী অবয়বের শেষ নেই,প্রতি দিনই নতুন নকসার ঘুড়ি তৈরী হচ্ছে। এর মধ্যে সোয়া কিলোমিটার দীর্ঘ্য ড্রাগন ঘুড়ি যেমন আছে,আবার দুই ইঞ্চি আয়তনের ছোট ঘুড়িও আছে। পাগল করা রং আকার-আকৃতির সব ঘুড়ি তৈরী হচ্ছে সারা বিশ্বময়।
আজকাল এই সকল আকর্ষণীয় ঘুড়ি নিয়ে দেশে দেশে আয়োজন করা হয় বিশাল বিশাল ঘুড়ি উৎসব। মনে করা হয় চীন দেশের প্রথম ঘুড়ি তৈরী ও ওড়ানো হয়েছিল চীনের সেংডং প্রভিন্সের ওয়েফাং এ। এই ওয়েফাংই এখন ঘুড়ি নগরী (kite capital of the world) হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত ।
অনেক দেশেই এখন আনন্দ ঘন পরিবেশে বড় বড় ঘুড়ির উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে পৌষ সংক্রান্তির মেলায় মূলত পতেঙ্গা ঘুড়ি ওড়ানো হতো ও ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা হতো। অবশ্য এই কাটাকাটি খেলার জন্য আন্তর্জাতিক কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন প্রচলিত ছিল না।
বর্তমানে জীবন সংগ্রামের কঠিন জালে মানূষের আবেগ- আনন্দাবেগ অনেকাংশে ক্ষুন্ন হওয়ায় এবং যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঘুড়ির এই পুরানো সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছিল।
১৯৯৯ ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাছরাঙ্গা লঞ্চে করে আমরা সূর্য উৎসবে নিঝুম দ্বীপে গেলাম। মুদ্রিত নির্দিষ্ট কৃত ছাপানো প্রোগ্রামে উল্লেখ থাকা সত্বেও আমার নিয়ে যাওয়া বছর দেড়েক পূর্বের সংগৃহিত ১৪/১৫টি আধুনিক ঘুড়ি সময়াভাবে ও বৃষ্টির কারণে ওড়ানো যায়নি, আমাদের বহনকারী বিরাট লঞ্চের সন্মুখ দিকে প্রজাপতি, ঈগল, ড্রাগন,পাখি,মৌমাছি ইত্যাদি বর্ণিল চমৎকার ঘুড়ি গুলি লটকাইয়া তাৎক্ষনিক একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। এবং পরে ছাদে নিয়ে উড়ানোর চেষ্টা হয়। এটাই আমাদের এ জাতীয় প্রথম ঘুড়ির আনুষ্ঠানিক আয়োজন। বর্তমানে প্রতি বছর দেশের আনাচে কানাচে স্থানীয় বহু ঘুড়ি উড্ডয়ন প্রদর্শনী উৎসব হয়। জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্র,শনিবার পৌষ সংক্রান্তিকে সামনে রেখে জাতীয় উৎসব আয়োজন করা হয় কক্সবাজারে।
ঘুড়ি পাগল মানুষ আমরা যারা ঘুড়ি তৈরী করি, ঘুড়ি সংগঠন করি, তৈরী করি আধুনিক ঘুড়ি। নকশা উপকরণের অভাব অনুভব করি। এটা মূলত ঘুড়ি মনস্কদের মনযোগ আরও শানিত করবে। নূতন নুতন আগ্রহ তৈরী করবে। এ রকম একটি স্বপ্ন থেকেই এ ক্যাটালগ পুস্তকের অবতারণা । এখানে আমাদের ঘুড়ি সহ নানা দেশের ঘুড়ির ছবি, নকশা, উপাদান,উপকরণ এবং ঘুড়ির উৎসব প্রদর্শনীর কিছু ছবি, পোস্টার ও প্রকাশনার ছবি দেয়া হলো।
ঘুড়ির প্রতি ভালবাসা থেকেই ঘুড়ির এ বই প্রকাশ। আকাঙ্খার শতভাগ পূরণ করে ক্যাটালগ পুস্তক তৈরী করা যায়নি বলাই বাহুল্য। আরও ভাল কিছুর স্বপ্ন ভবিষ্যতের জন্য থাকল। তৈরী করা এ পুস্তক থেকে ঘুড়ির প্রতি সামান্যতম আগ্রহ অনুভব করা সম্ভব হলে চেষ্টা স্বার্থক হয়েছে মেনে ধন্য হব।
ঘুড়ি আমাদের কাঠি কাপড় নাটাই সূতাই শুধুই নয় দেশের প্রিয় ছড়াকার কবি লেখকবৃন্দ ঘুড়ি ও ঘুড়িয়ালদের ভীষন ভাল বাসেন এ পুস্তক হাতে নিয়েই তা অনুভব করা যায়।
এখন হেন ঘুড়ি নাই যা ঘুড়ি ফেডারেশন এর হাতে নাই এবং ঘুড়ি ফেডারেশন তৈরী করে না। হাজার হাজার ঘুড়ি আছে আমাদের হাতে । আছে দানবীয় সব পকেট কাইট, আরো আছে হট এয়ার বেলুন। মাইক্রোলাইট প্লেন। প্যারা গ্লাইডার। প্যারা সেইল। প্যারা পাওয়ার ইত্যাদি।
বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন ১৪ বছর যাবৎ বাংলাদেশেও আধুনিক ঘুড়ি তৈরী করা এবং ঘুড়িকে জনপ্রিয় করা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন ডিজাইন তৈরী করছে, সংগ্রহ করছে এবং আধুনিক সকল উপকরণ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করছে। এসব নিয়ে ছুটে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে উৎসাহী বৃন্দকে ঘুড়ি তৈরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং ঘুড়ি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে ঘুড়িকে জনপ্রিয় করার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘুড়ি সংস্কৃতির ঐতিহ্যও বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছে। নুতন নুতন ডিজাইন বৈচিত্র্যের জন্য আধুনিক ঘুড়ি অনাসায়েই জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এ লক্ষ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং উৎসাহ দিয়ে আধুনিক ঘুড়ি বিষয়ে সংগঠিত করা হচ্ছে। ঘুড়ির উপকরণ নকশা বিষয়ে উল্লেখ করার মত বহু দূর অগ্রসর হয়েছে। সুক্ষ ও বৈশিষ্ট মত আকর্ষণীয় ঘুড়ি তৈরী এবং ওড়ানো নির্মল অনাবিল আনন্দ ও প্রতিভা দীপ্ত একটি স্বপ্নময় জগত ।
বর্তমানে মূলত তরুন, কিশোর এবং যুবকদের কম্পিউটারের মনিটরে খাঁচা বন্দি জীবন মন। হাফ ছাড়ার কোন সুযোগই নেই। সেই দিক থেকে আমাদের কিশোর-যুবকরা বিকল্প আনন্দ প্রশান্তি পেতে ঘুড়ি তৈরী করা ও ওড়ানোর মত একটি অনাবিল সৃষ্টিশীল আনন্দের সাথে সম্পৃক্ত থাকলে অহিতকর কোন পথে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। সীমাহীন আকাশে বা উন্মুক্ত আঙ্গিনায় উড়ন্ত ঘুড়ির সাথে সাথে মনেরও মুক্তি মিলবে । আমাদের ঘুড়ি চর্চা প্রসারিত হলে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সরকার অনুকুল হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জাকজমক পূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব আয়োজন করা সম্ভব হবে। আমরা সে স্বপ্নই দেখি।

মোঃ শাহজাহান মৃধা বেনু
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন