ঘুড়ির কথার কথা

রং এর মোহময় মন ভোলানো রংধনু তোরণ পেরিয়ে মন হারানোর প্রান্তর আকাশ সকল বয়সের মানুষের কাছেই রোমাঞ্চকর আকর্ষন। আকাশে পাখী ওড়ে, দূর আকাশে মেঘ ওড়ে,মানুষের মনও ওড়ে। শুধু রূপ কথার ইকারাস দেদেলাস কেন আমরা মানবকুল সকল যুগেই আকাশ জয়ে ব্যক্তিগত ও জাতীয় যোগ্যতা সামর্থ্য অনুযায়ী ব্রতী হয়ে আছি । মেধাবী মানব সন্তান তাই আকাশ জয়কে কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র হিসাবে আদিকাল থেকে দেখে এসেছে। আর এ আকর্ষণে মহাকাশ, চন্দ্র, মঙ্গল, শনি জয় করেই চলেছে । হট এয়ার বেলুন তথা ফানুস,জ্যাপলিন, গ্যাস বেলুন, উড়োজাহাজ, গাইরো প্ল্নে, গ্ল¬াইন্ডার হেলিকপ্টার, রকেট সবই মানব জাতি উদ্ভাবন করেছে আকাশ জয়ের নেশায়। আদি কালে আকাশ জয়ের এ বাসনায়ই মানুষ তৈরি করেছে ঘুড়ি।
ঘুড়ির মূল উপকরন কাগজ আবিস্কার হয় চীনে। কারিগরি দিক থেকেও চীন পুরাকাল হতেই অগ্রসর। চীনে ঘুড়ির লিখিত ইতিহাস ও আড়াই তিন হাজার বৎসরের পুরানো। এখন সারা দুনিয়ার মধ্যে চীনের ঘুড়ি চর্চাই ব্যাপক এবং সেরা। বিশ্ব ঘুড়ি ফেডারেশন, বিশ্ব ঘুড়ি মিউজিয়াম, বিশ্ব ঘুড়ি উৎসব সবই চীনের শেংডং প্রদেশে-এর ওয়েফাং-এ । আমাদের দেশেও শত শত বছর থেকে ঘুড়িমোদি, ঘুড়ি প্রেমিকরা ঘুড়ি তৈরি করে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন।
আমাদের দেশে পতেঙ্গা চারকোনা বা বাঙলা ঘুড়িই বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয়। সংস্কৃত শব্দ পতাঙ্গ এর অর্থ ঘুড়ি। সম্ভবত পতাঙ্গ শব্দ থেকে পতেঙ্গা নামের আগমন। পতেঙ্গা ঘুড়ি তৈরি ও ওড়ানো সহজ। সাধারনত পতেঙ্গা ঘুড়িই দোকানে কিনতে পাওয়া যায় আজকাল সামান্য দু একটা আধুনিক ঘুড়ির দোকান দেখা যায়।
বাংলা ঘুড়ির সাথে সাথে আমাদের দেশে উৎসাহী ঘুড়ি কুশলীগণ আরও তৈরি করতেন ঢোপ, ডাউস, চিলা, উড়োজাহাজ, কোয়ারে, মাছ ও চিলি ঘুড়ি ইত্যাদি। এ সকল ঘুড়ি অবশ্য দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। শৌখিন মেধাবী রোমান্টিক কারিগররা যার যার মত মনের মাধুরী মিশিয়ে তিলে তিলে শ্রম ও মেধা দিয়ে তৈরি করেন এ সকল ঘুড়ি । অনেক পরিশ্রমের ফলে তৈরী স্বপ্নের ঘুড়ি কখনো ওড়ে কখনো ওড়েও না। আমাদের দেশে মূলত ঘুড়ির ডিজাইন করা হয় ঐতিহ্যগত অনুমান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে। উন্নত সব দেশে বায়ূ , গতি ও সূত্র নির্ভর ডিজাইন তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতি আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। ঘুড়ি তৈরিতে কতগুলি অপরিহার্য্য হিসাব আছে। সুক্ষভাবে ঐ হিসাব মেনে নকশা ও ঘুড়ি তৈরী করতে হয। নকশা অনুসরণ করে নিখুঁতভাবে ঘুড়ি তৈরি করতে হয়। তা না হলে ঘুড়ি ওড়বে না। আমাদের দেশে ঘুড়ি তৈরিতে মূূলত বাঁশের শলা, কয়েক জাতের কাগজ, আঠা, সূতা ইত্যাদি ব্যবহার হয়। সাধারনত ঘুড়ির কাঠামোটি স্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়। আজকাল চীনসহ উন্নত দেশে ঘুড়ির আকার আকৃতির যেমন বৈচিত্র থাকে, উপকরণেও তেমনি থাকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নির্ভর। আধুনিক ঘুড়ির কাঠামো তৈরিতে কার্বন রড(শলাকা), পলিভিনাইল রড, গ্ল¬াস ফাইবার রড এবং ছাউনী হিসাবে অতি সূক্ষ সিল্ক থেকে শুরু করে বহুবিধ কাপড় ব্যবহার করা হয়। ঘুড়ির কাঠামো তৈরিতে খোলা ও জোড়ার সুবিধার জন্য আরও ব্যবহার করা হয় বহু রকমের জয়েন্ট ও বহু রকম সূবিধাজনক উপকরন । এ সকল ঘুড়ির বড় বৈশিষ্ট হল পরিবহণের সুবিধার জন্য প্রায় সকল ঘুড়িই খুলে ভাঁজ করে ছোট আকৃতির করা যায়। রূপ কথার ড্রাগন থেকে শুরু করে পাখী, কীটপতঙ্গ, মাছ, স্থলে জ্বলের হেন প্রাণী নেই, ঘর-বাড়ি সহ কোন অবয়বের শেষ নেই, প্রতিদিনই নতুন নকশার ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে সোয়া কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রাগন ঘুড়ি যেমন আছে,আবার দুই ইঞ্চি আয়তনের ছোট ঘুড়িও আছে। পাগল করা রং আকার-আকৃতির সব ঘুড়ি। এই সকল আকর্ষণীয় ঘুড়ি নিয়ে দেশে দেশে আয়োজন করা হয় বিশাল বিশাল ঘুড়ি প্রদর্শন, কাটাকাটি , ঘুড়ি মেলা ও ঘুড়ি উৎসব।
আমাদের দেশে সাধারনত কিশোর- যুবকরাই ঘুড়ি তৈরি করতে ও ওড়াতে পছন্দ করে। চীন,থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে পার্ক ও উন্মুক্ত প্রান্তরে ষাট সত্তর-উর্দ্ধ বয়সের ঘুড়িয়ালরা নিজের তৈরি ঘুড়ি পরম আনন্দে ওড়ায় ও উপভোগ করেন। প্রায়ই এসব বয়স্ক লোকের পাশে তাদের সমান উৎসাহী সহধর্মিনীরাও থাকেন। নিজের তৈরী বিলাসী ঘুড়ি, সূতা এবং শৌখিন বিভিন্ন আকারের অপূর্ব সুন্দর নাটাই ওরা ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশেও আধুনিক ঘুড়ি তৈরি করা এবং ঘুড়িকে জনপ্রিয় করা নিয়ে বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে মূলত কিশোর-যুবকদের কম্পিউটার মনিটরে খাঁচাবন্দি জীবন মন। আমাদের কিশোর-যুবকরা মেধা- ভৌতের নির্মল আনন্দে ঘুড়ি তৈরী করে মুক্ত আকাশের কাছে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে এতে প্রসারিত মহৎ হৃদয়বান প্রতিভাবান হবে এতে জাতীয় যুব সমাজের অবক্ষয় ঝুকি হ্রাস পাবে।
ঘুড়ি উৎসব থেকে অনেকে ব্যক্তিগত ও চক্রগত বিভিন্ন ভাবে বাণিজ্য মন্ডিত হতে দেখা যায়। ঘুড়ি ফেডারেশন নিজস্ব উদ্যোক্তা অংশ গ্রহণকারীদের বিনা মূল্যে যাওয়া আশা থাকা খাওয়া,ঘুড়ি ইত্যাদির খরচ বহণ করে,অন্যান্য দেশের মত বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে। আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জাঁকজমকপূর্ণ বড় আকারে সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব আয়োজন করতে সক্ষম হব।

১৯৯৯ ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাছরাঙ্গা লঞ্চে করে আমরা সূর্য উৎসবে নিঝুম দ্বীপে গেলাম। ছাপানো প্রোগ্রামে উল্লেখ থাকা সত্বেও আমার নিয়ে যাওয়া ১৪/১৫টি আধুনিক ঘুড়ি সময়াভাবে ও বৃষ্টির কারণে ওড়ানো যায়নি, ঐ লঞ্চের সন্মুখ দিকে প্রজাপতি,ঈগল,ড্রাগন,পাখি,মৌমাছি ইত্যাদি বর্ণিল চমৎকার ঘুড়ি গুলি লটকাইয়া তাৎক্ষনিক একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। এবং পরে ছাদে নিয়ে উড়ানোর চেষ্টা হয়। এটাই আমাদের এ জাতীয় প্রথম ঘুড়ি আনুষ্ঠানিক আয়োজন। বর্তমানে প্রতি বছর দেশের আনাচে কানাচে স্থানীয় বহু ঘুড়ি প্রদর্শনী উৎসব হয়। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকের পৌষ সংক্রান্তিকে সামনে রেখে জাতীয় উৎসব আয়োজন করা হয় কক্সবাজারে।
ঘুড়ি পাগল মানুষ আমরা যারা ঘুড়ি তৈরী করি, ঘুড়ি সংগঠন করি, তৈরী করি আধুনিক ঘুড়ি। নকশা উপকরণের অভাব অনুভব করি। এটা মূলত ঘুড়ি মনস্কদের মনযোগ আরও শানিত করবে। নূতন নুতন আগ্রহ তৈরী করবে। এ রকম একটি স্বপ্ন থেকেই এ ক্যাটালগ পুস্তকের অবতারণা । এখানে আমাদের ঘুড়ি সহ নানা দেশের ঘুড়ির ছবি, নকশা, উপাদান,উপকরণ এবং ঘুড়ির উৎসব প্রদর্শনীর কিছু ছবি, পোস্টার ও প্রকাশনার ছবি দেয়া হল।
ঘুড়ির প্রতি ভালবাসা থেকেই ঘুড়ির এ বই প্রকাশ। আকাঙ্খার শতভাগ পূরণ করে ক্যাটালক পুস্তক তৈরী করা যায়নি বলাই বাহুল্য। আরও ভাল কিছুর স্বপ্ন ভবিষ্যতের জন্য থাকল। ঘুড়ির প্রতি সামান্যতম ভালবাসা অনুভব করা সম্ভব হলে আমার চেষ্টা স্বার্থক হয়েছে মেনে ধন্য হব।
ঘুড়ি আমাদের কাঠি কাপড় নাটাই সূতাই শুধুই নয় দেশের প্রিয় ছড়াকার কবি লেখকবৃন্দ ঘুড়ি ও ঘুড়িয়ালদের ভীষন ভাল বাসেন এ পুস্তক হাতে নিয়েই তা অনুভব করা যায়।
এখন হেন ঘুড়ি নাই যা ঘুড়ি ফেডারেশন এর হাতে নাই এবং তৈরী করে না। হাজার হাজার ঘুড়ি আছে আমাদের হাতে । জায়েন্ট সব পকেট কাইট আরো আছে হট এয়ার বেলুন। মাইক্রোলাইট প্লেন। প্যারা গ্লাডার। প্যারা সেইল। প্যারা পাওয়ার ইত্যাদি।

মোঃ শাহজাহান মৃধা বেনু
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন