ঘুড়ি বানায় ঘুড়িয়াল,ঘুড়ি উড়ায় উড়িয়াল,শিশু,কিশোর,বৃদ্ধ,কবি,বিজ্ঞানী,দার্শনিক সকলেরই স্বপ্ন চারণ প্রান্তর আকাশ। শিশুর চাঁদ মামা, চাঁদের চর্কাকাটা বুড়ি,কবির মোহময় রঙ্গিণ মেঘ,বিজ্ঞানীর মহাকাশ গবেষণা,দার্শনিকদের অনেকের প্রাকৃত অতিপ্রাকৃত দর্শণের ধর্ম দর্শণের অনিবার্য বিচরণ ক্ষেত্র এই আকাশ-মহাকাশ। রংধনু,শিল্পীর কাঁচা রং মাখানো ভেসে যাওয়া মেঘ, মনোহর চাঁদ তাঁরা,সপ্তর্ষি কাল পুরুষ সকলের ঠিকানাই এই আকাশ। আকাশ জয়ের পাগল করা নেশায় মানুষ তৈরী করেছে ফানুষ বা হট এয়ার বেলুন,জাপলিন,গ্যাস বেলুন,এরোপ্লেন,গাইরো প্লেন, গ্লাইডার, হেলিকপ্টার, রকেট এবং ঘুড়িয়ালের ঘুড়ি। এ সব কিছুই একটি স্বপ্নের নাম যা দিয়ে আমরা মানবজাতি আকাশ জয় করেছিও।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশী ঘুড়ি তৈরী ও উড়ানো হয়। শৈশবে ঘুড়ি ছিল আমাদের স্বপ্নালু রঙিণ মনের একটি স্বপ্ন। সযতনে নিজের তৈরী বাঁশের কাঠি,মন মাতানো রংয়ের পাতলা কাগজ,জিগা গাছের আঠা,হাতুরী মার্কা কাটিম সুতা ইত্যাদি ছিল আমাদের স্বপ্নোপাদান ও কঠিন সাধনায় জোগানোর এ সকল উপাদান, তার সাথে থাকা মায়ের শাসন,বকুনী, আসকারা সমাহারে তৈরী ঘুড়ি নামের স্বপ্নটি যখন আকাশে ওড়তো! তা ঘুড়ি বানানোর সৃষ্টি সুখ,আকাশ জয়,নীল আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের পটে বর্ণময় ঘুড়ির খেলা বোঝা না বোঝা আবেগময় স্বপ্ন পূরণ শুধু অনুভব করার যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
নিকট আকাশে ওড়ে যে পতেঙ্গা বা বাংলা ঘুড়ি, আজকাল আমাদের খুব নিকটের দোকানেও সূলভে খুব কম দামে পাওয়া যায়। আমাদের ছোট বয়সে নিজে ঘুড়ি তৈরী করে ওড়াতে হত, আমাদের কাছে পিঠে কেনার ঘুড়ি পাওয়া যেত না। তখনকার ঘুড়ি বানানোর উপকরণ ছিল নিজের তৈরী বাঁশের কাঠি,কাগজ,আঠা, ওড়ানোর সুতা । সাধারণত ঘুড়ি ছিল ছোট আকারের। এখন বিশ্ব ব্যাপি মূলত বিভিন্ন জাতের রেশমি কাপড় থেকে অধিকাংশ কৃত্রিম কাপড় এবং কার্বন ষ্টিক,পলিভিনাইল রড,অপটিক্যাল ফাইবার রড এবং ঘুড়িয়ালের পছন্দের শত প্রকারের এক্সেসরিজ ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বয়কর খবর হচ্ছে ঘুড়ি তৈরীর এককালের অপরিহার্য কাঠি তথা কাঠির তৈরী কঠিন কাঠামো ছাড়াই ঘুড়ি তৈরী এবং ওড়ানো হয়। কালে কঠিন কাঠামো ছাড়া কোন ঘুড়ি ভাবা যেত না। বিশ্বের সব চাইতে আকাশ জোড়া বড় ঘুড়িটির কোন কাঠি বা কঠিন কাঠামো নেই,শুধুই কাপড়ের তৈরী।
আগের দিনের তৈরী ঘুড়ি গুটানো যেত না এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দূরের পথে পরিবহণ ছিল খুবই আপদ যুক্ত। কাগজ ও বাঁশের কাঠির তৈরী ঘুড়ি সহজেই ছিড়ে যেত এবং নষ্ট হয়ে যেত। বাঁশের তৈরী কাঠি বড় জোড় কয়েক মাস টিকত। এখনকার আধুনিক ঘুড়ির ও কাপড়, কৃত্রিম কাঠি ইত্যাদির তৈরী অনেক বড় বড় ঘুড়ি গুটিয়ে খুবই ছোট করে ফেলা যায়,একটি করে থলে গুটিয়ে সহজেই চল্লিশ/পঞ্চাশটি এক সঙ্গে বড় থলেতে বহণ করা যায়। এই সব ঘুড়ি দীর্ঘদিন টেকে এবং এর উপকরণ সহজে নষ্ট হয় না।
পুরাকাল থেকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি,ধর্মীয় আচার,যুদ্ধ প্রযুক্তি সর্বপরি নির্মল আনন্দ উপকরণ হিসাবে ঘুড়ি ব্যবহার মানব সভ্যতা বিকাশ ও প্রযুক্তি বিকাশের সূচনা থেকেই হয়ে আসছে। আমাদের সিলেটের কুলাউড়ায় শ্রী শ্রী বাসুদেব মন্দিন আঙ্গিনায় প্রায় ৪০০(চার) শত বছরের পুরানো ধর্মাচার হিসাবে বড় গ্রাম্য ঘুড়ি মেলা এবং ঘুড়ি ওড়ানোর ঐতিহ্য প্রচলিত বলে নির্দিষ্ট জনশ্রুতি আছে। প্রতি বছর মন্দির প্রাঙ্গনে চৈত্র মাসের শেষ রবিবার ঘুড়ি মেলার আয়োজন হয়।
বিশ্বব্যাপী উন্নত সকল দেশে প্রতি বছর বহু বহু জাতীয় ও আন্তর্র্জাতিক ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ঘুড়িয়ালরা প্রতিদিন নিত্য নূতন ঘুড়ির নকশা করে ঘুড়ি তৈরী করছেন।
বিশ্ব ঘুড়ি ফেডারেশন এর উদ্যোগে সারা বিশ্ব থেকে আসা অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে চীনের সেং দং প্রদেশের ‘ঘুড়ি নগরী ওয়েফাং’ এ প্রতি বছর ১৯-২৪ এপ্রিল মহা এক প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আসর বসে। সারা বিশ্ব থেকে ঘুড়িমোদি ঘুড়িয়ালরা এখানে নানা আকৃতির রঙের ঘুড়ি নিয়ে এসে জড়ো হন। সকলের সাথেই থাকে চমৎকারত্বি ও বৈশিষ্ট পূর্ণ ঘুড়ি। পৃথিবীর সব চাইতে দীর্ঘ ঘুড়িটি দেড় কিলোমিটার বা তার চাইতেও লম্বা। সব চাইতে ক্ষুদ্র আকৃতির ঘুড়ির আয়তন মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার । বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন মোটামুটি প্রতি বছরই ঐ আয়োজনে অংশ গ্রহণ করে। ঐ ওয়েফাং সারা জগতের ঘুড়িমোদিদের নিকট বিশ্বের শেরা তীর্থ ঘুড়িয়ালরা আদর করে নাম দিয়েছে Kite capital of the world. ওয়েফাং শহরে ঢুকলেই মনে হবে ঘুড়ির স্বপ্ন রাজ্যে পৌঁছে গেছি। সবই ঘুড়িময় রাস্তার লাইট পোষ্ট এয়ারপোর্ট,রেল ষ্টেশন,বাস ষ্টেশন, টেক্সিক্যাব,হোটেল,রাস্তাঘাটে,পার্ক,মাঠ,ব্রিজ সবই ঘুড়ির ব্যঞ্জনা যুক্ত অর্থাৎ ঘুড়িময়। ওয়েফাং শহরের অলিতে গলিতে ঘুড়ির দোকান এবং শহরের বিভিন্ন অঞ্চল জুরে ঘুড়ির কারখানা । এখান থেকে পৃথিবী ব্যাপী ঘুড়ি রপ্তানি হয়। চীনা ঘুড়ির পিতা চু-ই-চউ এর জন্মও এ এলাকায়। এই সূত্রেই এই শহরকে ঘুড়ি বিশিষ্ট করে তৈরী করা হয়েছে। বিশ্ব ঘুড়ি ফেডারেশন এই শহরে। অবিশ্বাস্য সুন্দর করে তৈরী করা হয়েছে বিশ্ব ঘুড়ি মিউজিয়াম ও অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্বলিত মিউজিয়াম আঙ্গিনা ঘুড়ির ষ্টেডিয়াম। সে বাংলাদেশের ঘুড়ি ঐতিহ্যকে জনপ্রিয় ও আধুনিক ধারায় বিকশিত করে তোলার লক্ষে ঘুড়ি ফেডারেশন নানামুখি কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন একাধিক কারাখানা শত সহশ্র রকমের জাতের ঘুড়ি তৈরী করে এবং উৎসাহীদেরকে ঘুড়ি তৈরী করার প্রশিক্ষণ দিয়ে চলছে।
সারা বিশ্ব ব্যাপী এক দিকে ঘুড়ি নিয়ে এত আয়োজন এত মনোযোগ অবাক করা সব নূতন ঘুড়ি তৈরী অপর দিকে ভয়ংকর খবর এখনকার কিশোর-যুবকরা মূলত কম্পিউটারে মনিটরের জুড়ে ফ্রেমে বন্দি হয়ে ক্রিকেট খেলে,ফুটবল খেলে, গাড়ীর রেস খেলে,চেয়ারে বসে বসেই কম্পিউটারে এভারেষ্ট সৃঙ্গ আরোহণ করে,যুদ্ধ করে, এমনকি ঘুড়িও ওড়ায়। এরূপ চলতে থাকলে মানবজাতির মানবিক সঙ্গা লোপ পাবে। অবস হয়ে পরবে ভবিষ্যতের মানুষের সকল সচল মানবিক গুনাবলি । এটা হবে প্রকৃতির সন্তান সমগ্র মানব জাতির জন্য সৃষ্টি হবে ভয়াবহ এক বিকল ভয়ংকর ভবিষ্যৎ। আমরা চাই ঘুড়ি ওড়ানোর তাগিদে আমাদের কিশোর যুবকরা মুক্ত আকাশের খোঁজে,খেলার মাঠে উন্মুক্ত প্রান্তরে নদীর তীরে -চরে,সুমুদ্র সৈকতে যাবে,আকাশ দেখবে,রোদে পুড়বে,বৃষ্টিতে সিক্ত হবে,নিজের তৈরী বেয়াড়া ঘুড়িটা সামলাবে,কখনও হেরে যাবে, আবার জিতবে , আকাশ জয় করবে। এটাই হওয়া উচিৎ আমােেদর স্বপ্ন। আর বাহুল্য বলা এই যে এতে অবশ্যই জাতীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। দিতে হবে উৎসাহ, প্রয়োজনীয় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, যা থেকে এখনো বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন বঞ্চিত। বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন প্রতি বৎসর প্রায় নিজ খরচে জাতীয় উৎসব সহ বড় বড় উৎসব প্রদর্শনী আয়োজন করে থাকে। এ একটি কঠিন কাজ। আমরা সকলে বিশ্বাস করি ঘুড়ির সবাইকে আকৃষ্ট করার সহজাত শক্তি আছে। ঘুড়ির ভালবাসার ঐ শক্তি ব্যবহার করে আমরা প্রয়োজনীয় জন স্বার্থের কঠিন কথার প্রতি মনোযোগী করে পরিবেশন করতে পারা যায়। বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়ি মুক্ত দিবসে তাই জনস্বার্থের অকাট্য অপরিহার্য কথা বলার প্রয়োজনে এ উৎসব – মেলায় ঘুড়ি নিয়ে আমরা প্রতিবারই আসি।
মোঃ শাহজাহান মৃধা বেনু
( লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা, আধুনিক ঘুড়ি নকসা বিদ, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা যোদ্ধা )